মায়াবতী-২ অধরা জেরিন | Mayaboti 2 Odhora Jarin Part - 3 The End

মায়াবতী-২ অধরা জেরিন | Mayaboti 2 Odhora Jarin Part - 3 The End

মায়াবতী-২
পর্ব তিন এবং শেষ
লেখা: অধরা জেরিন

নাহ আবীর আর আসেনি।ওকে আমি কোনো দিন আর দেখতে পাইনি।শুনেছিলাম ও নাকি হঠাৎ করে দেশের বাইরে চলে গেছে। কেন? কি জন্য? সেটা কেউ জানে না।কিন্তু ও যাওয়ার আগে আমার মনটা নিয়ে গেলো।ওকে ভুলতে পারবো না কোনো দিন।
এভাবে কেটে গেলো চার বছর। এই চার বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আমি একটা স্কুলে জব নিলাম। অরিন দেশে এসে বিরাট বিজনেস শুরু করলো। ছোট চাচার দুই মেয়ে কলেজে উঠলো। চাচীও শেষ অবধি ঠান্ডা হয়ে গেলো।

আগের মতো সারা দিন ঝগড়া করতো না।
সব কিছু চলে যেতে লাগলো শুধু আমি ভালো ছিলাম না।আবীরের কষ্ট তিলে তিলে শেষ করে দিতে লাগলো। অচেনা অজানা মানুষ যে একদিনে এতোটা আপন হতে পারে আমার জানা ছিল না।

একদিন বিকেলে বসে বসে স্কুলের খাতা দেখছিলাম এমন সময় ছোট চাচার বড়ো মেয়ে এসে বললো,
--আপু তাড়াতাড়ি বাইরে চলো। কে যেনো এসেছে বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।
আমি ওর কথা শুনে অবাক হলাম। তাড়াতাড়ি করে ওর সাথে গেলাম দেখতে। যেয়ে দেখি বয়স্ক মতো একটা লোক চাচাকে বলছে,
--আনাস ভাই আমার ওদের একটু ডাক দে।দেখে আমার বুকের জ্বালা দুর করি।
--ভাইজান, আপনার ছেলে মেয়ে দুটো সোনার টুকরো। কেন ওদের ছেড়ে চলে গেলাম। আপনার এই অভিমান বাবা মাকে নিও গেলো ওপারে।
-- আমি সব জানি।কিন্তু সাহস হয়নি তোদের সামনে দাড়াতে। নিজে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছি ভাই। আমায় তোরা মাফ করে দে। শুধু ওদের এক নজর দেখে চলে যাবো।এই মুখ নিয়ে কোনো দিন সামনে আসবো না।

আমি সব কথা শুনে বুঝে গেছি লোক টা কে।আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। সামনে আমার জন্ম দাতা দাড়িয়ে। বহু বছর পর এই প্রথম তাকে দেখছি।
এমন সময় চাচা আমাকে দেখে ডাক দিয়ে বললো,
--মারে এদিকে আয়।
আমি আস্তে আস্তে কাছে গেলাম। অরিন ও আমার সাথে এলো।ও আমার মতো সব কিছু জেনে গেছে। কাছে আসতেই চাচা বললেন,
---এই তোদের জনম দুঃখী বাবা।

আমার চোখে পানি ছলছল করছে। বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
--- আমার কাছে আয়, আমি তোদের এক নজর দেখে চলে যাবো।আমাকে তাড়িয়ে দিস না।আমি পিতা নামের কলংক। তোদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কতো বড়ো হয়ে গেছিস তোরা। তোদের আমি ছুয়ে দেখবো না।শুধু মনটা ভরে দেখবো।

এই বলেই হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। কিন্তু সব অভিমান গলা চেপে কষ্ট হয়ে বেধে রাখলো।অরিনের ও চোখ ভেজা। আমি ওর চোখ দেখে বুঝে গেছি বাবাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বাবা বলে ডাকতে ছটফট করছে।
,
বাবা কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললো,
--আমি চলে যাচ্ছি তোরা ভালো থাকিস।আর কোনো দিন তোদের সামনে আসবো না।
এই বলেই চলে যেতে লাগলো। বাবার চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল কেউ কলিজা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম,
--চলেই যখন যাবে তখন কেন আসলে। দিনের পর দিন কেঁদেছি বাবা বলে ডাকবো বলে। আজও ছেড়ে চলে যাবে? একবার আমাদের বাবা বলে ডাকতে দাও।
বাবা আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি ও কাঁদছি আজ চোখের পানি বের করে দিচ্ছি যতো জমানো ছিল। অরিন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে বললো,
--বাবা তুমি আর কোথাও যাবে না আমাদের ছেড়ে। আমরা তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে চাই না।

ছোট চাচা দুরে দাড়িয়ে কাঁদছে। বাবা হাতের ইশারায় কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরলো।

রাতে খেতে বসে বাবা আমাদের দুই ভাই বোন কে মুখে তুলে দিলো। আমরা আজ অনেক খুশি। বাবা ফিরে এসেছে আমার বাবা। যতোই অপরাধ করুক না কেনো বাবা আমাদের কাছে শুধুই বাবা। যার তুলনা শুধুই তিনি নিজেই।

------------

ইদানীং অরিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক বদলে যাচ্ছে। আমি ডেকে একদিন বললাম,
-- কি হয়েছে রে ভাই তোর?
--কেন কি হবে?
--না আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারনি না বল কি হয়েছে?
-- আমার একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে।
--- ওমা এতো ভালো খবর। কে সে?
---মেয়ে আমাদের ঘরের তনু।
--- তুই তনুকে পছন্দ করিস ও জানে?
---তনু ও আমাকে পছন্দ করে।
---হুম, লুকিয়ে লুকিয়ে কতো দিন শুনি?
--- এই দুই বছর।

কিইই এতো কিছু আমি জানি না। চাচাকে বলছি আপনার বড়ো মেয়েকে আমার ভাইয়ের অনেক পছন্দ।
আমি এ কথা বলতেই অরিন লজ্জা পেয়ে ছুটে পালালো।মনে মনে ঠিক করলাম চাচাকে বলবো ওদের কথা।

পরদিন সকালে চাচী এসে বললো,
-- আজ তোকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছে তোর বাবা।
--কিন্তু কেন চাচী?আজ আমার স্কুল এ বাচ্চাদের পরীক্ষা।
আমার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বললো,
--মারে আজ যে কথা তোর মায়ের বলার কথা ছিল তাই আমি বলতে এলাম। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে মা মনে করে মাফ করে দিস।
---তুমি আমার মা চাচী। মায়ের দোষ ধরতে নেই বলো কি হয়েছে?
---বিকেলে তোকে দেখবে আসবে। অনেক ভালো ছেলে। মাত্র দু ভাই। ছেলে একাউন্ট ম্যানেজার।
--- ওওও, বাবা আর চাচা আগের থেকেই সব ঠিক করে এসেছে।
---নারে মা।তোর অমতে কিছু হবে না আগে আসতে দে ওদের দেখে যাক।
---ঠিক আছে।

বিকেলে আমি ছেলের সামনে বসে আছি। ছেলেকে দেখেই আবীরের মুখটা ভেসে উঠলো।হুবহু একই রকম দেখতে। আমাকে আর ছেলেকে আলাদা রুমে কথা বলতে দেওয়া হলো। ওখানে যেয়ে ছেলে আমাকে বললো,
--আমি আরিফ,একাউন্ট ম্যানেজার। দুই ভাইয়ের আমি বড়ো। আপনার সব কিছু আমি জানি নতুন করে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। আপনার কিছু জানার থাকলে বলুন।

আমি একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলাম,
-- আমি দেখতে অনেক কালো।এটা জেনে ও বিয়ে করতে কেন রাজি হলেন?
---এর উত্তর যদি আমাদের মিলন থেকে থাকে, তাহলে প্রথম রাতে বলবো।

এক মাস পর আমাদের বিয়ে ঠিক হলো।এক সাথে দুটো বিয়ে হবে আমার সাথে আরিফের আর অরিনের সাথে তনুর। ওদের কথা চাচাকে আমি বলেছিলাম কারো কোনো আপত্তি নেই।

রাতে বাবা আমার ঘরে এলো আমাকে বললো,
--- আরিফ অনেক ভালো ছেলে মা ,তোকে সুখে রাখবে।
আমি বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে চলেছি। সবাই কে ছেড়ে যেতে হবে এটা মনে হলেই খুব কান্না পাচ্ছে।

--------------------­------

আজ বিয়ে,
যথাসময়ে সব কিছু শেষ হলো।এবার আমার বিদায়ের পালা। আপন মানুষদের ছেড়ে চলে যাওয়া কতোটা কষ্ট এটা বুঝানো সম্ভব না।তবুও আমার যেতে হবে। সব মায়া ছিন্ন করে। যাওয়ার আগে বাবা চাচা অরিন সবাই খুব কেঁদেছিল। আচ্ছা পৃথিবীতে এই নিষ্ঠুর নিয়ম কে করেছিল। নিজের কন্যাকে নিজ হাতে সাজিয়ে পর করে দিতে হবে।

আমাকে শ্বশুর বাড়িতে আনা হলো।আমাকে বরন করে ঘরে উঠালো।নতুন বউয়ের আনার পর যে নিয়ম থাকে সব শেষ হলো। আমি বাসর ঘরে বসে আছি।
একটু পর আরিফ ঘরে এলো।আমি বুঝতে পেরে নেমে সালাম করলাম ঠিক এমন সময় একটা চিৎকার কানে এলো।
কেউ কাঁদছে আর বলছে আমাকে ছাড়ো আমি নতুন বউ দেখবো।

আমি আচমকা এমন কথায় একটু অবাক হলাম। আরিফ ওটা বুঝতে পেরে বললো,
--আমার ছোট ভাই আবীর। মানসিক রুগী।

আবীর নামটা শুনা মাত্র আমি কেঁপে উঠলাম। আবীর কোন আবীর?

আরিফ নিজে বাইরে গিয়ে আবীরকে আমার সামনে নিয়ে এলো। এবার আমি ওকে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। আবীর আমার সামনে দাড়িয়ে। কিন্তু ওর এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে ওর? কোথায় ছিল এতোদিন?

অনেক গুলো কেন মনের ভিতরে জমা হলো।আরিফ আমাকে দেখিয়ে বললো,
---এই যে নতুন বউ আবীর। তোর বউকে পছন্দ হয়েছে।

আবীর ছোট বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিয়ে বললো,
---সুন্দর বউ অনেক সুন্দর। আমি এখানে ঘুমাবো।নতুন বউয়ের কাছে তোমার কাছে। হি হি হি।
--- আমার সোনা ভাই। এই ঘরে তো নতুন বউ থাকবে। তুই পাশের ঘরে ঘুমাবি।
---না আমি এখানে থাকবো।

এমন সময় দুই তিন জন আবীর কে জোর করে নিয়ে গেলো। আমি হা হয়ে গেছি।কি হচ্ছে এসব।আবীরের কি হয়েছিল।

আরিফ ওরা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে আমার পাশে বসে বললো,
--তুমি জানতে চেয়েছিলে না তুমি কালো তবুও কেন বিয়ে করলাম?
অরিত্রা,
যাকে তুমি দেখলে আমার বড়ো আদরের ছোট ভাই। আজ ভাগ্যের দোষে এই অবস্থা। কয়েকবছর আগের কথা। ও তখন ভার্সিটিতে পড়ে ওটাই ছিল শেষ বছর।
একদিন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো,
---ভাইয়া তাড়াতাড়ি কিছু টাকা দে।
---এই কাল ও টাকা দিয়েছি।আমার কাছে টাকা নেই।
--প্লিজ ভাইয়া দে।আজ মায়াবতীর সাথে আমার দেখা করার কথা।
---মায়াবতী কে?
---যাকে আমি ভালোবাসি।
--মেয়েটার নাম তাহলে মায়াবতী?
---আরে না ওকে আমি ভালোবেসে মায়াবতী ডাকি।জানিস ভাইয়া ও দেখতে কালো তাই আমার সাথে প্রেম করতে চাইছিল না।কিন্তু ওর চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর। ভিষণ মায়াবী।ওর চোখ দেখে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।আর ও আমাকে ভালোবাসে আমি চোখ দেখে বুঝেছি।
---তাই নাকি এতো প্রেম।
--- ভাইয়া কালো মেয়ে গুলো বেশি মায়াবতী হয়। তাই আমি আমার মায়াবতী কে মায়াবতী বলি।

এই বলেই বাইকের চাবিটা নিয়ে যেতে যেতে বললো,
---বাইক নিয়ে গেলাম। মায়াবতী কে নিয়ে সারাদিন ঘুরবো।

কিন্তু একটু পর খবর এলো আবীর গুরুতর এক্সিডেন্ট করেছে। আমরা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওখান থেকে ফেরত দিলো। অনেক চেষ্টা করে একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।ওখান থেকে বললো,,
--অবস্থা খারাপ তাড়াতাড়ি দেশের বাইরে নিতে হবে।

ছয় মাস পর আমরা ফিরে এলাম। কিন্তু আবীর ঠিক হলোনা। রাত বেশি হলেই মায়াবতী মায়াবতী বলে কেঁদে ওঠে। কখনও হাসে কখনও কাঁদে। এই জন্য তোমাকে আমি আমার মায়াবতী করেছি। আমার ছোট ভাই বলতো কালো মেয়ে গুলো মায়াবতী হয়।

সব কিছু শুনে আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। নিজেকে মনে হচ্ছে এসবের জন্য দায়ী।আবীর তাহলে সেদিন সত্যি ওর কথা রেখেছিল। আমি হুহু করে কেঁদে দিলাম। আবীর আমাকে মাফ করে দিও।আমার জন্য তোমার এই অবস্থা। যতোদিন বাঁচবো তোমার সেবা করে যাবো।হঠাৎ করে আমার একটা হাত আরিফ চেপে ধরলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
- অরিত্রা কেদনা।
আমার মাথা আরিফের বুকের ভিতরে। চোখের পানি টপটপ করে পরে বিয়ের শেরওয়ানি ভিজে যাচ্ছে। তবুও আমি কেঁদে চলেছি। এই কয়েক বছরের জমিয়ে রাখা জল বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে যেতে লাগলো।
(সমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments